Skip to main content
 

আমাদের কথা

নোয়াখালী জেলার ইতিহাস

বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত চট্টগ্রাম বিভাগের একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী জেলা হচ্ছে নোয়াখালী। হাতিয়া, নিঝুম দ্বীপ, সুবর্ণচর সহ অনেক চর নিয়ে গঠিত এই জেলা। প্রশাসনিকভাবে এই জেলায় মোট ০৯ টি উপজেলা রয়েছে। আধুনিক নোয়াখালী ভূ-খণ্ডের প্রাচীন নাম ভুলুয়া। ভুলুয়া ছিল বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী অঞ্চলের ইতিহাসের স্নায়ু কেন্দ্র। ঐতিহাসিক সুবর্ণ গ্রাম তথা একালের সোনারগাঁও এর প্রখ্যাতির বহু আগে থেকেই ভুলুয়া ছিল একটি বর্ধিষ্ণু সমুদ্র বন্দর। এর তীর ঘেঁষে প্রবহমান ছিল প্রাচীন পুথি এবং কিংবদন্তিতে বর্ণিত ক্ষীরদ সাগর বা ক্ষীর সাগর। প্রাচীন এই ক্ষীর সাগরই আজকের বঙ্গোপসাগর। খ্রিষ্টপূর্বে ভুলুয়া বন্দর প্রাচীন পৃথিবীর আন্তর্জাতিক নৌ-বাণিজ্যের একটি কেন্দ্র ছিল। ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্য ভাগে দিল্লির সুলতান ছিলেন মুহাম্মদ বিন তুঘলক। তাঁর শাসনের শুরুর দিকে ভুলুয়া অঞ্চল সহ গোটা সমতট অঞ্চল ছিল একটি স্বাধীন এলাকা। চতুর্দশ শতকের তৃতীয় দশকে ত্রিপুরা ও ভুলুয়া এবং চট্টগ্রাম দখল করে তুঘলকের সেনাপতি এই এলাকা'কে দিল্লীর সাম্রাজ্য ভুক্ত করেন। এর পর বাহরাম খান ভুলুয়ায় তার শাসন কেন্দ্র স্থাপন করেন। এর পর তুঘলক তাঁর পূর্বাঞ্চলীয় রাজধানী ভুলুয়ার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন ফখরুদ্দিনকে। বৌদ্ধ, পাল, সেনযুগ এবং পরবর্তীকালে বাংলার স্বাধীন সুলতানি আমল, পাঠান তুর্কি আমল, মোঘল আমল সহ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির যুগ পর্যন্ত ভুলুয়ার অস্তিত্ব ছিল। ভুলুয়ার ভৌগোলিক অবস্থান ছিল বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতির উত্তরে ভবানী গঞ্জের সন্নিকটে। ১৭৭৩ সালে মেজর রেনেল অঙ্কিত বাংলাদেশের প্রাচীনতম মানচিত্রে দেখা যায় উত্তরের পর্বত থেকে উৎসারিত নদীগুলো দক্ষিণের সুবিস্তীর্ণ সমতলের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রে পড়েছে। দক্ষিণে ছিল তখন ভুলুয়া, বামনি, শহর কসবা, ফরাজগঞ্জ, ভবানিগঞ্জ ও কোম্পানীগঞ্জ সহ বহু সমুদ্র বন্দর। ঐতিহাসিকদের বিবরণ থেকে জানা যায় গত দুইশত বছরের মধ্যে সমুদ্র কোন কোন ভূ-খন্ডে সাত থেকে দশ বার গ্রাস করেছে। সেই হিসাবে ধরে নেওয়া যায় প্রাচীন ভুলুয়াও এই সময়ে সমুদ্র গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। মোঘল আমলে মেঘনার তীরবর্তী যে বিখ্যাত বন্দরটি ছিল সে বন্দরটির নাম ছিল শহর কসবা। সেটির আবার আরেক নাম ছিল ভুলুয়া বন্দর। ভুলুয়া বন্দরের উত্তরে ছিল ভুলুয়ার বিশাল রাজবাড়ি, ভুলুয়ার দিঘি, রাজাদের দুর্গ আর ভূলুয়ার রাজধানী। ১৮২১ খ্রিষ্টাব্দ সালে এই অঞ্চলকে জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হলেও তা ভুলুয়া নামেই পরিচিত ছিল এবং ১৮৬৮ সালে ভুলুয়ার প্রশাসনিক নাম হয় নোয়াখালী। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে জেলা হিসেবে নোয়াখালী পূর্ণ মর্যাদা লাভ করে। একই সাথে প্রথম নোয়াখালী পৌরসভা গঠিত হয় 1876 খ্রিষ্টাব্দে। নোয়াখালী পৌরসভা গঠিত হয় সুধারাম নামে একজন “ভূ” অধিকারীর দানকৃত স্থানে। তাই প্রথম থেকে এই শহর সুধারাম শহর হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। নোয়াখালীর ইতিহাসে অন্যতম ঘটনা 1830 সালের জিহাদ আন্দোলন এবং 1920 সালের খেলাফত আন্দোলনে নোয়াখালীর জনগনের সক্রিয় অংশগ্রহণ। 1946 সালে মাহাত্মা গান্ধী শান্তি মিশনে নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ আসেন এবং বেগমগঞ্জের জয়াগ নামক স্থানে গান্ধীজির নামে গড়েন গান্ধী আশ্রম। এটি ঐতিহাসিক ও জনকল্যানকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে।

নোয়াখালী জেলা ও দায়রা জজ আদালতের ইতিহাস-ঐতিহ্য

১৮৭৬ খ্রিঃ নোয়াখালী জেলা হিসেবে পূর্ণ মর্যাদা লাভ করার পর ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দ সনের ০১ লা মে থেকে দেওয়ানী ও সেশন আদালত পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হয় এবং জেলা জজের পদ সৃষ্টি হয়। সুধারাম শহরে জজকোর্ট ভবন ছিল লাল ইটের তৈরী একটি দোতলা দালান। শতাব্দীর প্রাচীন নোয়াখালী জজকোর্ট ছিল কলকাতা হাইকোর্টের ধাঁচের তৈরী টাইলস সু-শোভিত। জজকোর্ট ভবনটি ছিল শহরের প্রধানতম আকর্ষণ। তবে সেটি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেলে বর্তমান মাইজদী শহরে নতুন করে জেলা ও দায়রা জজ আদালত ভবন স্থাপিত হয়। ০১/০১/১৯৪৯ সন হতে মাইজদীতে জজকোর্টের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৬৫ সনে জেলা জজ আদালত ভবন নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে ০৬/০৪/২০০৬ খ্রি: তারিখে নতুন ভবন উদ্ভোধনের পর হতে নতুন ভবনে বর্তমানে বিচার কার্যক্রম চলছে। ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দ সনে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ করা হলে নোয়াখালীতে চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সৃষ্টি হয়। ১০/১০/২০১9 খ্রি: তারিখে চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের আধুনিক নতুন ভবন উদ্ভোধনের পর হতে উক্ত ভবনে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাগণ বিচার কার্য পরিচালনা শুরু করেন।

 

 

হাতিয়া চৌকি আদালতের বৃত্তান্ত

নোয়াখালী জেলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় ২টি চৌকি আদালত রয়েছে। তথায় একটি সিনিয়র সহকারী জজ আদালত এবং একটি সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত রয়েছে। চৌকি আদালতের প্রথম কার্যক্রম শুরু হয় 19 জানুয়ারী 1912 খ্রিষ্টাব্দ তারিখে। হতিয়া আইনজীবী সমিতির প্রথম সভাপতি জনাব এডভোকেট নব চন্দ্র দাশ এবং প্রথম সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান হাতিয়া দ্বীপের প্রথম অনরারী ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল মোতালেব, বি.এ.বি.টি এবং হাতিয়া কোর্টের প্রথম ম্যাজিষ্ট্রেট মোহাম্মদ শামছুদ্দিন।

 

আইনজীবী সমিতির ইতিহাস

নোয়াখালী জেলা আইনজীবী সমিতি প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে। বর্তমান বার এসোসিয়েশন ভবনের দক্ষিণ পূর্ব দিকে একটি টিনের ঘরে বার এসোসিয়েশনের কার্যক্রম চালু ছিল। ১৯৭২ ইং সনে জনাব আবদুল মালেক উকিল সাহেব বর্তমান বার ভবনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৭৭ ইং সনে বার লাইব্রেরী বর্তমান ভবনে স্থানান্তর করা হয়। আইন পেশার বাইরে নোয়াখালী বারের সদস্য জনাব আবদুল গোফরান, জনাব খান বাহাদুর রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, জনাব আবদুল মালেক উকিল, জনাব মোঃ ইসমাইল বিভিন্ন সময়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। জনাব আবদুল মালেক উকিল বার কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। জনাব ছায়েদুল হক, জনাব ফজলুর রহমান, জনাব ছেরাজ উদ্দিন আহম্মদ, জনাব মুনসুরুল হক, জনাব মোঃ রুহুল আমিন, জনাব আলী আজ্জম, জনাব সাকায়েত উল্যা, জনাব বিসমিল্লাহ মিয়া, জনাব অধ্যাপক মোহাম্মদ হানিফ, জনাব সালাউদ্দিন কামরান সংসদ সদস্য ছিলেন। জনাব সৈয়দ আবদুল মজিদ চৌধুরী ও জনাব সৈয়দ আহাম্মদ জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৭১ সনে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে নোয়াখালী আইনজীবী সমিতির তৎকালীন সদস্য এডভোকেট আবদুল মালেক উকিল, এডভোকেট সাখাওয়াত উল্যা, এডভোকেট বিসমিল্লাহ মিয়া, এডভোকেট আবদুর রব, এডভোকেট জয়নাল আবদীন, এডভোকেট লুৎফুর রহমান, এডভোকেট আবুল খায়ের এবং এডভোকেট ফজলুল কবির মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও রনাঙ্গণের মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট সারোয়ার-ই-দ্বীন, এডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান লতু, এডভোকেট মমিন উল্যাহ, এডভোকেট মোঃ শাহজাহান, এডভোকেট নেয়ামত উল্যা মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আইনজীবী সমিতিতে যোগদান করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে পাক-হানাদার বাহিনীর হাতে নোয়াখালী আইনজীবী সমিতির বিজ্ঞ সদস্য রায় বাহাদুর এডভোকেট নগেন্দ্র সুর এবং এডভোকেট নরেন্দ্র কুমার নির্মমভাবে শহীদ হন।

 

সম্পাদনাকারী: মাসফিকুল হক, যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ, নোয়াখালী।

তথ্যসূত্র:

1। জনাব এডভোকেট জয়নাল আবদীন।

2। জনাব এডভোকেট গোলাম আকবর।

 

গ্রন্থপঞ্জী:

1। নোয়াখালী একটি হারানো শহরের ইতিকথা, লেখক: -এডভোকেট গোলাম আকবর। 

2। সাগরকন্যা হাতিয়ার ইতিহাস ও রাজনীতি ব্যক্তিত্ব ঐতিহ্য বিষয়ক নির্বাচিত কলাম, ফজলে এলাহী শাহীন।

3। সাগরকন্যা হাতিয়ার 100 ব্যক্তিত্বের জীবনী লেখক:- ফজলে এলাহী শাহীন।